ঢাকা ০৩:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি :
সারাদেশের জেলা উপোজেলা পর্যায়ে দৈনিক স্বতঃকণ্ঠে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে । আগ্রহী প্রার্থীগন জীবন বৃত্তান্ত ইমেইল করুন shatakantha.info@gmail.com // দৈনিক স্বতঃকণ্ঠ অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭১১-৩৩৩৮১১, ০১৭৪৪-১২৪৮১৪

দক্ষিণে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি করেছে পদ্মাসেতু

বার্তাকক্ষ
  • প্রকাশিত সময় ০৮:৪৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ জুলাই ২০২২
  • / 155


অর্থনৈতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৪৮ অপরাহ্ন, ৮ জুলাই ২০২২

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় সেখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে বড় কোম্পানিগুলি। এর মাধ্যমে তারা অঞ্চলটির ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে লাভবান হতে চাইছে।

নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য এ অঞ্চলে জমি খুঁজছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেলটেক, প্রাণ-আরএফএল, টিকে গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ এবং অপসোনিন ফার্মার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এ অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রম এবং বিশেষত কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের কাঁচামালের সহজলভ্যতা- তাদের উৎসাহিত করছে। ঢাকার বাইরে শিল্পস্থাপনে কর অবকাশের সুবিধা এবং পদ্মা সেতু পর্যন্ত সরাসরি নির্মিত নতুন হাইওয়ে রুটগুলিও তাদের আগ্রহী করছে।

২০১৯ সালে দক্ষিণের জেলা ভোলায় দেশের সর্ববৃহৎ সিরামিকস শিল্প গড়ে তোলে শেলটেক গ্রুপ। স্থানীয় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে উৎপাদন, সস্তা জমি ও পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার প্রত্যাশায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর ভোলায় নতুন করে শেলটেক এবার নন-ডেনিম পোশাক কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে বলে জানিয়েছেন গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ।

‘আমরা এখন বরিশালেও তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপনে জমি খুঁজছি’ বলে জানান তিনি। তবে এখনই নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ জানাননি।

নদীপথে কম খরচে পণ্য পরিবহনের জন্য দক্ষিণাঞ্চল আগে থেকে আকর্ষনীয় ছিল। তবে ফেরিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা ও অনিশ্চিয়তার জন্য উদ্যোক্তারা যাননি।

‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর এখন দক্ষিণে বিনিয়োগই সবচেয়ে লাভজনক বলে মনে করছি’- উল্লেখ করেন কুতুবউদ্দিন আহমেদ।

দেশের ২০টি স্থানে ২৩টি কারখানা রয়েছে উৎপাদন খাতে শীর্ষ কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। দেশের বাইরে রয়েছে ৫টি কারখানা। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো প্রডাক্টশন হাব নেই তাদের।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এ অঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা ও হালকা প্রকৌশল শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে জানিয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল।

কৃষি-ভিত্তিক ব্যবসা সবচেয়ে আকর্ষনীয়

মেঘনা গ্রুপ, হামীম গ্রুপ, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, মীর গ্রুপ এবং ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো প্রায় ৫০টি বড় কোম্পানি দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে জানতে পেরেছে টিবিএস।

দেশে অটোমোবাইল শিল্পে বড় নাম ঢাকা-ভিত্তিক বৃহৎ শিল্পগ্রুপ নিটল-নিলয়। ভারত থেকে গাড়ির সম্পূর্ণ নকড ডাউন কিট (সিকেডি) আমদানি করে তা গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের কারখানায় সংযোজন করে তারা।

‘আমরা যশোর ও বরিশালে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছি’ বলে গণমাধ্যমকে জানান নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলুব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনই যশোরে বাস, ট্রাক এবং মিনিবাসের জন্য একটি সংযোজন (অ্যাসেম্বলি) প্ল্যান্ট পরিচালনা করছি। পদ্মা সেতু হওয়ার পর এটি সম্প্রসারণের কথা ভাবছি।’

দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতার কথা উল্লেখ করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও বলছেন তিনি।

এজন্য গ্রুপটি বরিশাল ও শরীয়তপুরে জমি খুঁজছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ পেলেই সেখানে বড় করে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নামব’।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি আরও জানান, পদ্মা সেতু হওয়ার পর দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলির প্রায় সবাই দক্ষিণাঞ্চলে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। গ্যাস সংযোগ পেলে বরিশাল-ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ হবে পরবর্তী ম্যানুফ্যাকচারিং হাব।

আরেক ব্যবসায়ী নেতা মীর নাসির হোসেন জানান, ঢাকার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের সুবিধা নিতে এর মধ্যেই ফরিদপুরে কারখানা স্থাপন করেছে তার কোম্পানি মীর গ্রুপ।

দেশের শীর্ষ দশ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে অন্যতম অপসোনিন ফার্মা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ২০২০ সালে বরিশালে ৫০০ একর জমিতে দেশের সর্ববৃহৎ ফার্মা প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে এ কারখানায় ১০০০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছেন অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান।

তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজ হওয়ায় বরিশাল শিল্প-কারখানা গড়ার উপযুক্ত স্থান। দারুণ সম্ভাবনার কারণেই এখানে বিপুল বিনিয়োগ করছি।’

পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি-ভিত্তিক শিল্প করার পরিকল্পনা করছে টিকে গ্রুপও। যদিও সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিনিয়োগ শুরু করে এখন পর্যন্ত এলপিজে সিলিন্ডার ও ভোজ্য সয়াবিন উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

টিকে গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সীকম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, পায়রা ও মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চল আগে থেকেই ব্যবসার উপযুক্ত জায়গা। ‘এখন পদ্মা সেতু হওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে সহজ যোগাযোগের কারণে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে পরিকল্পনা করছি।’

পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও মৎস পণ্যকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রফতানি বাজার ধরতে চায় ঢাকা-ভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ।

ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারপার্সন এবং এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে. চৌধুরী বলেন, অবকাঠামো সংকটে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজ, আলু, ডাল, বাদাম, সরিষা, সবজিসহ বহু পণ্য প্রক্রিয়াজাত হতো না। কৃষকরা সঠিক দাম পেতো না, আবার নষ্ট হতো। যদিও এসব পণ্য রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

“পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনার ক্ষেত্র ওখানকার কৃষি পণ্য। এখন প্রথমেই আমরা ঢাকার আশেপাশে সাইলো স্থাপন করে সেখানকার পণ্য এনে সংরক্ষণ করবো। গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলে তখন প্রক্রিয়াকরণ কারখানাও করা যাবে”- যোগ করেন তিনি।

পদ্মা সেতুর সুফল পেতে বড় শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগে নামছেন দক্ষিণাঞ্চলে। এদেরই একজন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী শিকদার।

পদ্মা সেতুর ঠিক ওপাড়ে জাজিরা উপজেলার কাজীরহাট এলাকায় ১০ বিঘা জমিতে শিকদার হিমাগার নামে একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তিনি।

মোবারক আলী বলেন, ‘এই এলাকায় প্রচুর টমেটো হয়। আমি এগুলো রফতানির জন্য সংরক্ষণ করব।’

১৭ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করবে বেজা

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এই তিন বিভাগের ২১টি জেলায় নতুন করে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) স্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, মোংলায় বাস্তবায়নাধীন দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিগগিরই শিল্প নির্মাণকাজ শুরু হবে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল।

তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় ৩৮২ একর জমির ওপর নির্মিত হবে কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকার নবাবগঞ্জে মাওয়ার কাছে প্রায় ৮০০ একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিকল্পিত শিল্পায়ন আরও গতিশীল হবে। এই অঞ্চলে এক কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, পর্যটন, কৃষি ও আইসিটি খাতে বড় বিনিয়োগের জন্য কাজ শুরু করেছে।

কয়েক দশক পর শিল্পনগরীর ঐতিহ্যে ফিরবে খুলনা

ষাটের দশকের শেষদিকে খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন প্রায় শিল্পহীন নগরী বলা যায় খুলনাকে।

তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর খুলনা আবার শিল্পোদ্যোক্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে এসেছে। অনেকেই শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কিনছেন।

তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “আমি নিশ্চিতভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছি। খুলনায় একটি নতুন পোশাক কারখানা স্থাপন করতে চাই। শুধু তাই নয়, আমার অন্য পরিচিত ব্যবসায়ীদেরকেও এ অঞ্চলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করব।”

বঙ্গবন্ধু সেতু যেভাবে উত্তরবঙ্গে শিল্পায়নকে উৎসাহিত করেছে

দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ১৯৮১ সালে রংপুর বিসিকে আরএফএল ফাউন্ড্রি নামে কারখানা নির্মাণ করে টিউবওয়েলের ব্যবসা শুরু করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে পরের দুই দশক তারা উত্তরবঙ্গে আর কোনো কারখানা করেনি।

বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর শিল্পগোষ্ঠীটি ২০০১ সালে নাটোরে প্রাণ-এগ্রো লিমিটেড নামে কারখানা স্থাপন করে। এরপর একে একে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় আরও আটটি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করে প্রাণ গ্রুপ। সম্প্রতি একটি বাইসাইকেল উৎপাদন কারখানার কাজও শুরু করেছে তারা।

শুধু প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ নয়, দেশের অন্য শিল্পগোষ্ঠীগুলো উত্তরবঙ্গে কারখানা করেছে। যেমন- স্কয়ার গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, নীলসাগর গ্রুপ।

স্কয়ার গ্রুপের পাবনায় নিজস্ব শিল্পপার্ক করেছে। আবার এনভয় গ্রুপ একই জেলায় বেঙ্গল মিট নামে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা করেছে।

 


 আরও পড়ুনঃ

 আরও পড়ুনঃ


দক্ষিণে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি করেছে পদ্মাসেতু

প্রকাশিত সময় ০৮:৪৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ জুলাই ২০২২


অর্থনৈতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৪৮ অপরাহ্ন, ৮ জুলাই ২০২২

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় সেখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে বড় কোম্পানিগুলি। এর মাধ্যমে তারা অঞ্চলটির ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে লাভবান হতে চাইছে।

নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য এ অঞ্চলে জমি খুঁজছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেলটেক, প্রাণ-আরএফএল, টিকে গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ এবং অপসোনিন ফার্মার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এ অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রম এবং বিশেষত কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের কাঁচামালের সহজলভ্যতা- তাদের উৎসাহিত করছে। ঢাকার বাইরে শিল্পস্থাপনে কর অবকাশের সুবিধা এবং পদ্মা সেতু পর্যন্ত সরাসরি নির্মিত নতুন হাইওয়ে রুটগুলিও তাদের আগ্রহী করছে।

২০১৯ সালে দক্ষিণের জেলা ভোলায় দেশের সর্ববৃহৎ সিরামিকস শিল্প গড়ে তোলে শেলটেক গ্রুপ। স্থানীয় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে উৎপাদন, সস্তা জমি ও পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার প্রত্যাশায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর ভোলায় নতুন করে শেলটেক এবার নন-ডেনিম পোশাক কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে বলে জানিয়েছেন গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ।

‘আমরা এখন বরিশালেও তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপনে জমি খুঁজছি’ বলে জানান তিনি। তবে এখনই নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ জানাননি।

নদীপথে কম খরচে পণ্য পরিবহনের জন্য দক্ষিণাঞ্চল আগে থেকে আকর্ষনীয় ছিল। তবে ফেরিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা ও অনিশ্চিয়তার জন্য উদ্যোক্তারা যাননি।

‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর এখন দক্ষিণে বিনিয়োগই সবচেয়ে লাভজনক বলে মনে করছি’- উল্লেখ করেন কুতুবউদ্দিন আহমেদ।

দেশের ২০টি স্থানে ২৩টি কারখানা রয়েছে উৎপাদন খাতে শীর্ষ কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। দেশের বাইরে রয়েছে ৫টি কারখানা। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো প্রডাক্টশন হাব নেই তাদের।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এ অঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা ও হালকা প্রকৌশল শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে জানিয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল।

কৃষি-ভিত্তিক ব্যবসা সবচেয়ে আকর্ষনীয়

মেঘনা গ্রুপ, হামীম গ্রুপ, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, মীর গ্রুপ এবং ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো প্রায় ৫০টি বড় কোম্পানি দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে জানতে পেরেছে টিবিএস।

দেশে অটোমোবাইল শিল্পে বড় নাম ঢাকা-ভিত্তিক বৃহৎ শিল্পগ্রুপ নিটল-নিলয়। ভারত থেকে গাড়ির সম্পূর্ণ নকড ডাউন কিট (সিকেডি) আমদানি করে তা গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের কারখানায় সংযোজন করে তারা।

‘আমরা যশোর ও বরিশালে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছি’ বলে গণমাধ্যমকে জানান নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলুব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনই যশোরে বাস, ট্রাক এবং মিনিবাসের জন্য একটি সংযোজন (অ্যাসেম্বলি) প্ল্যান্ট পরিচালনা করছি। পদ্মা সেতু হওয়ার পর এটি সম্প্রসারণের কথা ভাবছি।’

দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতার কথা উল্লেখ করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও বলছেন তিনি।

এজন্য গ্রুপটি বরিশাল ও শরীয়তপুরে জমি খুঁজছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ পেলেই সেখানে বড় করে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নামব’।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি আরও জানান, পদ্মা সেতু হওয়ার পর দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলির প্রায় সবাই দক্ষিণাঞ্চলে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। গ্যাস সংযোগ পেলে বরিশাল-ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ হবে পরবর্তী ম্যানুফ্যাকচারিং হাব।

আরেক ব্যবসায়ী নেতা মীর নাসির হোসেন জানান, ঢাকার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের সুবিধা নিতে এর মধ্যেই ফরিদপুরে কারখানা স্থাপন করেছে তার কোম্পানি মীর গ্রুপ।

দেশের শীর্ষ দশ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে অন্যতম অপসোনিন ফার্মা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ২০২০ সালে বরিশালে ৫০০ একর জমিতে দেশের সর্ববৃহৎ ফার্মা প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে এ কারখানায় ১০০০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছেন অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান।

তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজ হওয়ায় বরিশাল শিল্প-কারখানা গড়ার উপযুক্ত স্থান। দারুণ সম্ভাবনার কারণেই এখানে বিপুল বিনিয়োগ করছি।’

পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি-ভিত্তিক শিল্প করার পরিকল্পনা করছে টিকে গ্রুপও। যদিও সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিনিয়োগ শুরু করে এখন পর্যন্ত এলপিজে সিলিন্ডার ও ভোজ্য সয়াবিন উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

টিকে গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সীকম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, পায়রা ও মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চল আগে থেকেই ব্যবসার উপযুক্ত জায়গা। ‘এখন পদ্মা সেতু হওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে সহজ যোগাযোগের কারণে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে পরিকল্পনা করছি।’

পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও মৎস পণ্যকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রফতানি বাজার ধরতে চায় ঢাকা-ভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ।

ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারপার্সন এবং এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে. চৌধুরী বলেন, অবকাঠামো সংকটে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজ, আলু, ডাল, বাদাম, সরিষা, সবজিসহ বহু পণ্য প্রক্রিয়াজাত হতো না। কৃষকরা সঠিক দাম পেতো না, আবার নষ্ট হতো। যদিও এসব পণ্য রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

“পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনার ক্ষেত্র ওখানকার কৃষি পণ্য। এখন প্রথমেই আমরা ঢাকার আশেপাশে সাইলো স্থাপন করে সেখানকার পণ্য এনে সংরক্ষণ করবো। গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলে তখন প্রক্রিয়াকরণ কারখানাও করা যাবে”- যোগ করেন তিনি।

পদ্মা সেতুর সুফল পেতে বড় শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগে নামছেন দক্ষিণাঞ্চলে। এদেরই একজন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী শিকদার।

পদ্মা সেতুর ঠিক ওপাড়ে জাজিরা উপজেলার কাজীরহাট এলাকায় ১০ বিঘা জমিতে শিকদার হিমাগার নামে একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তিনি।

মোবারক আলী বলেন, ‘এই এলাকায় প্রচুর টমেটো হয়। আমি এগুলো রফতানির জন্য সংরক্ষণ করব।’

১৭ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করবে বেজা

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এই তিন বিভাগের ২১টি জেলায় নতুন করে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) স্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, মোংলায় বাস্তবায়নাধীন দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিগগিরই শিল্প নির্মাণকাজ শুরু হবে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল।

তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় ৩৮২ একর জমির ওপর নির্মিত হবে কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকার নবাবগঞ্জে মাওয়ার কাছে প্রায় ৮০০ একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিকল্পিত শিল্পায়ন আরও গতিশীল হবে। এই অঞ্চলে এক কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, পর্যটন, কৃষি ও আইসিটি খাতে বড় বিনিয়োগের জন্য কাজ শুরু করেছে।

কয়েক দশক পর শিল্পনগরীর ঐতিহ্যে ফিরবে খুলনা

ষাটের দশকের শেষদিকে খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন প্রায় শিল্পহীন নগরী বলা যায় খুলনাকে।

তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর খুলনা আবার শিল্পোদ্যোক্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে এসেছে। অনেকেই শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কিনছেন।

তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “আমি নিশ্চিতভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছি। খুলনায় একটি নতুন পোশাক কারখানা স্থাপন করতে চাই। শুধু তাই নয়, আমার অন্য পরিচিত ব্যবসায়ীদেরকেও এ অঞ্চলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করব।”

বঙ্গবন্ধু সেতু যেভাবে উত্তরবঙ্গে শিল্পায়নকে উৎসাহিত করেছে

দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ১৯৮১ সালে রংপুর বিসিকে আরএফএল ফাউন্ড্রি নামে কারখানা নির্মাণ করে টিউবওয়েলের ব্যবসা শুরু করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে পরের দুই দশক তারা উত্তরবঙ্গে আর কোনো কারখানা করেনি।

বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর শিল্পগোষ্ঠীটি ২০০১ সালে নাটোরে প্রাণ-এগ্রো লিমিটেড নামে কারখানা স্থাপন করে। এরপর একে একে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় আরও আটটি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করে প্রাণ গ্রুপ। সম্প্রতি একটি বাইসাইকেল উৎপাদন কারখানার কাজও শুরু করেছে তারা।

শুধু প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ নয়, দেশের অন্য শিল্পগোষ্ঠীগুলো উত্তরবঙ্গে কারখানা করেছে। যেমন- স্কয়ার গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, নীলসাগর গ্রুপ।

স্কয়ার গ্রুপের পাবনায় নিজস্ব শিল্পপার্ক করেছে। আবার এনভয় গ্রুপ একই জেলায় বেঙ্গল মিট নামে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা করেছে।

 


 আরও পড়ুনঃ

 আরও পড়ুনঃ